তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণের পর ১০০ কর্মকর্তা নিহত : জাতিসঙ্ঘ
রোববার আফগানিস্তানের পরিস্থিতির ওপর জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে পেশ করা এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, হত্যার শিকার হওয়া দুই-তৃতীয়াংশ ব্যক্তি তালেবান যোদ্ধা বা তার সহযোগীদের হাতে নিহত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী ও আন্তর্জাতিক সামরিক বাহিনীর সাথে কাজ করা সাবেক সদস্যদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা সত্ত্বেও (আফগানিস্তানে জাতিসঙ্ঘের সহায়তা মিশন) ইউএনএএমএ সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের হত্যা, অপহরণ ও অন্য সহিংসতার অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য সূত্র থেকে পেতে থাকে।’
প্রতিবেদনে জানানো হয়, জাতিসঙ্ঘ মিশন ৪৪টি সাময়িক গ্রেফতারি, মারধর ও হুমকির ঘটনা নথিভুক্ত করে। এর মধ্যে ৪৪টিই তালেবান যোদ্ধাদের দ্বারা সংগঠিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতিসঙ্ঘের মিশন আফগানিস্তানে উগ্রবাদী আইএসের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে বিচার বহির্ভূতভাবে অন্তত ৫০ ব্যক্তিকে হত্যার তথ্য জানতে পেরেছে। এছাড়া আট সিভিল সোসাইটি অ্যাক্টিভিস্ট হত্যা এবং আরো ১০ জন গ্রেফতারি ও হুমকির শিকার হন বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।
তালেবানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর থেকে আফগানিস্তানে মোট দুই সাংবাদিক হত্যার শিকার হন। এছাড়া অপর দুইজন অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের হামলায় আহত হন বলে জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আফগানিস্তানে তালেবান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকরা নিয়মিতভাবে ‘হামলা, হয়রানি, হুমকির’ শিকার হয়ে আসছেন।
এতে বলা হয়, ‘তালেবানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার ছয় মাস পার হলেও আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিতই রয়ে গিয়েছে। সাথে সাথে দেশজুড়ে বিবিধ রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও মানবিক সহায়তামূলক কর্মকাণ্ড থমকে গিয়েছে।’
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার জেরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ হামলার জন্য আফগানিস্তানে আশ্রয়ে থাকা আলকায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে দায়ী করেন। ওই সময় আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান সরকারের কাছে ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানান বুশ।
তালেবান সরকার ওসামা বিন লাদেনকে তুলে দেয়ার পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার সাথে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে মার্কিনিদের কাছে প্রমাণ চায়। প্রমাণ ছাড়া তারা ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন প্রশাসনের কাছে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
বুশ প্রশাসন ও তালেবানের মধ্যে বিরোধের জেরে ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে আগ্রাসন শুরু করে মার্কিন বাহিনী। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রসজ্জ্বিত মার্কিন সৈন্যদের হামলায় তালেবান সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়।
তবে একটানা দুই দশক যুদ্ধ চলতে থাকে দেশটিতে।
এরইমধ্যে আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের সদস্য দেশগুলোও যুক্ত হয়। মার্কিনিদের সমর্থনে নতুন প্রশাসন ও সরকার ব্যবস্থা গড়ে উঠে দেশটিতে।
২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন সৈন্যদের এক ঝটিকা অভিযানে নিহত হন ওসামা বিন লাদেন। ২০১৩ সালে অজ্ঞাতবাসে তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরেরও মৃত্যু হয়।
তা স্বত্ত্বেও তালেবান যোদ্ধারা আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখে।
দীর্ঘ দুই দশক আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বের বহুজাতিক বাহিনীর দখলের পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাতারের দোহায় এক দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার করতে সম্মত হয় যুক্তরাষ্ট্র। এর বিপরীতে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অংশ নিতে তালেবান সম্মত হয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ঘোষণা অনুসারে ৩১ আগস্ট আফগানিস্তান থেকে বহুজাতিক বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের ডেডলাইন থাকলেও ৩০ আগস্ট সম্পূর্ণ সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন হয়।
মার্কিনিদের সাথে চুক্তি অনুসারে ক্ষমতাসীন থাকা মার্কিন সমর্থনপুষ্ট আফগান সরকারের সমঝোতার জন্য তালেবান চেষ্টা করলেও দুই পক্ষের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। তালেবানের অভিযোগ, আশরাফ গনির নেতৃত্বাধীন আফগান সরকার দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়নি।
এর পরিপ্রেক্ষিতে মে মাসে বহুজাতিক বাহিনীর প্রত্যাহারের মধ্যেই পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালানো শুরু করে তালেবান।
৬ আগস্ট প্রথম প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে দক্ষিণাঞ্চলীয় নিমরোজ প্রদেশের রাজধানী যারানজ দখল করে তারা। যারানজ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার ১০ দিনের মাথায় কেন্দ্রীয় রাজধানী কাবুলে পৌঁছে যায় তালেবান যোদ্ধারা। তালেবানের অগ্রসরে আশরাফ গনির কাবুল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার জেরে আফগান প্রশাসন ভেঙে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ আগস্ট কাবুলে প্রবেশ করে তালেবান যোদ্ধারা।
তবে কাবুলের উত্তরের দুর্গম পাঞ্জশির প্রদেশ শুধু তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়ে গিয়েছিলো। আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসন প্রতিরোধ যুদ্ধের কিংবদন্তি যোদ্ধা আহমদ শাহ মাসুদের ছেলে আহমদ মাসুদের নেতৃত্বে তালেবানবিরোধী বিদ্রোহী যোদ্ধারা এই উপত্যকায় অবস্থান নিয়েছিলো।
৬ সেপ্টেম্বর পাঞ্জশির নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুরো আফগানিস্তানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে তালেবান। এর পর ৭ সেপ্টেম্বর দলীয় প্রধান মোল্লা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদাকে রাষ্ট্রপ্রধান ও রাহবারি শুরার সদস্য মোল্লা হাসান আখুন্দকে প্রধানমন্ত্রী করে নতুন আফগান সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় দলটি।
কোন মন্তব্য নেই