রোবট: মানুষের কাজ কেড়ে নিচ্ছে নাকি কর্মী সংকট কমাচ্ছে?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাসপাতাল, সুপার মার্কেট ও অন্যান্য স্থানের মেঝে পরিষ্কার বা জীবাণু ধ্বংসের জন্য রোবট বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। শুরুতে কর্মী সংকট বা সংক্রমণ এড়াতে এ ব্যবস্থা প্রচলন করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সংক্রমণ কমে এলেও দেখা গেছে, এ পদ্ধতি চলমান রয়েছে। কারণ কিছু প্রতিষ্ঠান মনে করছে, স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি বেশ সুবিধা দিচ্ছে। আবার মানুষের সংস্পর্শ ছাড়াই এসব কাজ করানোকে নিজেদের বিপণন বাড়াতে ও প্রচারে কাজে লাগানো হচ্ছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ফাস্ট ফুড চেইন হোয়াইট ক্যাসল এখনো হ্যামবার্গার তৈরির জন্য রোবট ব্যবহার করছে। আর তাদের রেস্তোরাঁয় মানুষের হাতের সংস্পর্শ ছাড়াই বার্গার তৈরি হয় বলে প্রচারণা চালাচ্ছে।
মহামারীর ভয়ানক দিনগুলো আমরা পেরিয়ে এসেছি বলেই প্রত্যাশা করা হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে চাকরির বাজারের পরিস্থিতি অনেক জটিল আকার ধারণ করেছে। একদিকে যেমন বেকারত্বের হার বাড়ছে, তেমনি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে দেখা দিয়েছে কর্মী সংকট। বিশেষ করে যেসব কাজে তুলনামূলক কম বেতন, সেগুলোর জন্য যথাযথ কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না।
এমনকি ২০১৯ সালে কর্মরত ছিলেন এমন কয়েক লাখ ব্রিটিশ নাগরিক এখন বেকার বসে আছেন। মহামারীর আগের সময়ের চাইতে কর্মক্ষেত্রে শূন্য পদের হার বেড়েছে ২০ শতাংশ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর্মী নিয়োগের জন্য রীতিমতো বিপদে পড়েছেন নিয়োগকর্তারা। তবে প্রচুর বেকার কর্মী থাকার পরও কেন কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে সে বিষয়টি স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না। একটি ধারণায় বলা হচ্ছে, মহামারীর কারণে কর্মীদের অর্থ দিয়ে সাময়িক ছুটিতে পাঠানোর কারণে এখন আর কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেক কর্মী আছেন যারা আগে হয়তো কম বেতনের কাজ করতেন। কিন্তু এখন আর তা করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। আবার ব্রেক্সিটের কারণে প্রচুর কর্মী হারাতে হয়েছে যুক্তরাজ্যকে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অন্তত দুই লাখ কর্মীকে আইনের বিধিনিষেধের কারণে যুক্তরাজ্য ছাড়তে হয়েছে। যারা হয়তো কৃষি, পরিবহন ও অবকাঠামোগত কাজে ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।
সবকিছু মিলিয়ে চলমান কর্মী সংকট বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী করে তুলছে। বিশেষ করে ব্রিটিশ যে খামারগুলোতে ইউরোপের বিভিন্ন ছোট দেশের কর্মীরা কাজ করতেন তারা এখন কৃষিকাজে পারদর্শী রোবটের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ফলে এখন যুক্তরাজ্যে নানা ধরনের রোবট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন স্টার্টআপ এ কাজে সময় ব্যয় করছে। সম্প্রতি একটি ছোট প্রতিষ্ঠান এমন এক ধরনের রোবট তৈরি করেছে যেটি গমের ক্ষেত থেকে আগাছা পরিষ্কারে সক্ষম। ফলে এজন্য আলাদা করে রাসায়নিক ব্যবহারের আর প্রয়োজন পড়বে না। রোবটিতে সংযুক্ত ক্যামেরার সাহায্যে সে নির্ভুলভাবে আগাছা চিনতে পারে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী যথাযথ স্থান থেকে তা উপড়ে ফেলতে পারে।
আরেকটি স্টার্টআপ কোম্পানি ২০১৮ সালেই যুক্তরাজ্য সরকারের তহবিল পেয়েছে, যা দিয়ে নাজুক ফল ও সবজি সংগ্রহ করার মতো রোবট তৈরি করা হবে। যেন এসব রোবট ব্যবহার করে মানুষের চেয়ে দ্রুতগতিতে টমেটোর মতো সবজি বা ফল সংগ্রহ করা যায়। রোবটগুলো যেন কেবল সবচেয়ে পাকা ফলটিই সংগ্রহ করতে পারে সেজন্য ব্যবহার করা হচ্ছে আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স।
যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে রেস্তোরাঁ খাতে। সে কারণে অনেক রেস্তোরাঁই এখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও বার্গারের প্যাটি তৈরির মতো কাজগুলোর ভার মেশিনের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। ম্যাকডোনাল্ড’সের মতো রেস্তোরাঁ চেইনও গ্রাহকদের অর্ডার নেয়ার মতো কাজ স্বয়ংক্রিয় ভয়েস সিস্টেমের মাধ্যমে করছে।
প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এভাবে অটোমেশনে চলে যেতে থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে তার প্রভাব পড়বে চাকরির বাজারে। কারণ রোবটের বয়স হয় না, তার ছুটির প্রয়োজন হয় না, সে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পাড়ে থাকে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছরে কাজের ক্ষেত্রে নাটকীয় পরিবর্তন দেখবে উন্নত বিশ্ব।
এমনকি প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অনেক উচ্চ পর্যায়ের কাজ, যেগুলোকে ভীষণ মর্যাদাপূর্ণ মনে করা হয়, সেগুলোও চলে যেতে পারে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের দখলে। তথ্য বিশ্লেষণ বা তথ্য সরবরাহের মতো কাজগুলো মানুষের বদলে রোবটের মাধ্যমে করা হলে নির্ভুল হবে বলে মনে করা হচ্ছে। মহামারী-পরবর্তী বিশ্বে কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকতে হলে এমন আরো অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে কর্মীদের। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায় কর্মীরা যেন প্রস্তুত হতে পারেন, তারা যেন হুট করে বেকার না হয়ে পড়েন, সেদিকে যেমন লক্ষ রাখতে হবে তেমনি কারিগরি শিক্ষার ওপরও জোর দিতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গার্ডিয়ান অবলম্বনে
কোন মন্তব্য নেই