শোকে স্তব্ধ শ্রীলঙ্কা - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

শোকে স্তব্ধ শ্রীলঙ্কা

চোখের পানিতে স্বজনদের বিদায় আইএসের দায় স্বীকার ও ৮ জনের ছবি প্রকাশ : মৃত বেড়ে ৩২১ : গ্রেফতার ৪০ : তাওহীদ জামায়াতের আঁতুরঘর ভারত : বোরকা নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে : আসছে এফবিআই


শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বোমা হামলায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় শোক দিবস পালিত হয়েছে। সকালে তিন মিনিটের নীরবতা পালন করেছেন দেশবাসী। স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে আটটার দিকে এই নীরবতা পালনকালে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। গত রোববার সকাল সাড়ে আটটার দিকেই প্রথম বোমা হামলায় হয়। এ কারণে সে সময়েই শ্রদ্ধা জানান শ্রীলঙ্কাবাসী। পানীয়ের দোকানগুলো বন্ধ রাখা হয়। রেডিও ও টিভি চ্যানেলে বেদনার সুর বাজানো হয়। কলম্বোর সেন্ট অ্যান্টনি’স গির্জায় প্রথম আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরিত হবার স্থানে মানুষ মোমবাতি জ্বেলে নীরবে প্রার্থনা করেন। পরিচিতি নিশ্চিত হওয়াদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াও গতকাল সম্পন্ন হয়েছে। রোববারের ওই হামলায় নিহতের সংখ্যা গতকাল ৩২১-এ পৌঁছেছে। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের মধ্যে অনেকেই শঙ্কায় থাকায় মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। আততায়ীদের সাথে সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে গতকাল আরো মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ফলে আটকের সংখ্যা ৪০-এ পৌঁছেছে। এদের সবাই স্থানীয়। সিএনএন-এ প্রচারিত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে হামলাকারীদের একজন ভারী ব্যাগ বহন করছে পিঠে। সেন্ট সেবাস্টিয়ান গির্জায় প্রবেশের আগে সে একটি শিশুর মাথা স্পর্শ করছে। ওই গির্জায় অনেকেই বিস্ফোরণে নিহত হয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডের দিন সিরিজ বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাকারীসহ আটজনের ছবি প্রকাশ করেছে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। আইএসের মুখপত্র আমাক নিউজ অ্যাজেন্সি সেই ছবি প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, হামলার মাস্টারমাইন্ডসহ আত্মঘাতী সাতজন হামলাকারী ছবিতে থাকা ব্যক্তিরা।
এর আগে গতকাল ‘আমাক’ এক বিবৃতিতে জানায়, শ্রীলঙ্কায় হামলা চালিয়েছে আইএসের যোদ্ধারা। হামলার পর আইএসের ‘যোদ্ধা’রা এখন উল্লাস করছে। পরে হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে উগ্রপন্থী ধর্মীয় নেতা জাহরান হাশিমের ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আইএস বলছে, তিনিই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী।
তবে তার পাশে থাকা অন্য সাতজনের মুখ কাপড়ে ঢেকে দেওয়া রয়েছে। জঙ্গি গোষ্ঠীর তরফ থেকে আগেই বলা হয়েছে তাদের নাম, আবু ওবায়দা, আবু আল মুক্তার, আবু খলিল, আবু আল বাররা, আবু মুহাম্মদ এবং আবু আবদুল্লাহ। তারা সবাই আইএসের পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে ফ্রেমবন্দি হয়েছেন। আইএস আগের বিবৃতিতে জানিয়েছে, হামলার টার্গেট ছিল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষজন।
গতকাল মঙ্গলবার সকালেই পার্লামেন্টে দেশটির প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুয়ান বিজেবর্ধনে দাবি করেছেন, নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে গুলি চালানোর ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডে উদযাপনের সময় একের পর এক বোমা হামলা চালানো হয়। শ্রীলঙ্কান দুটি ইসলামিক গ্রুপ এই হামলার সঙ্গে যুক্ত বলেও দাবি করেন তিনি।
সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, এ ধরনের গভীর ও জটিল হামলা চালাতে যে সরঞ্জাম লাগে, এর প্রস্তুতিতে কয়েক মাস সময় দরকার। এর মধ্যে আত্মঘাতী সদস্য জোগাড় করা ও বিস্ফোরকদ্রব্য পরীক্ষার মতো বিষয়ও রয়েছে। এছাড়া দায় স্বীকারে বিলম্বের বিষয়টিও তাদের নজরে এসেছে। কারণ, হামলার পর দ্রুত দায় স্বীকার আইএসের স্বাভাবিক নিয়ম।
ওদিকে বিশ্লেষকরা সিরিজ হামলার পেছনে শ্রীলঙ্কার ক্রমশ উত্থান এবং মার্কিন-ভারতীয় বলয় থেকে বেরিয়ে চীনের সাথে ঘনিষ্টতার বিষয়টিতে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. মইনুল ইসলাম শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার জন্যই আন্তর্জাতিক একটি শক্তি এ হামলা চালিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি গত সোমবার জাতীয় একটি দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, শ্রীলঙ্কা থেকে চীনের প্রেসার সরানোর জন্যই এ হামলা চালানো হয়েছে। মইনুল ইসলাম বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একসময় বিশ্বের সুপার পাওয়ারের একটি ছিল। সেই শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র এখন ক্ষয়িষ্ণুর পথে। এখন সে অর্থে পৃথিবীর অন্য দেশগুলো আর যুক্তরাষ্ট্রের কথা শোনেও না, মানেও না। আর বর্তমান পৃথিবীতে চীনের যে শক্তি তা অনেক গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে চীনের অর্থনৈতিক শক্তি এবং অন্যান্য দেশের ওপর চীনের প্রভাব, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপের সঙ্গেও দেশটির সুসম্পর্ক রয়েছে।

বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক বলেন, আমরা জানি যে শ্রীলঙ্কায় চীনের সহযোগিতায় একটি পোর্ট হচ্ছিল। আর সেই পোর্ট নির্মাণের কারণে ভারত শ্রীলঙ্কার ওপর কিছুটা অসন্তুষ্ট ছিল। এজন্য ভারতীয় কন্ট্রাক্টরদের পোর্ট নির্মাণের জন্য কাজও দেয়া হয়েছিল। আমার মনে হচ্ছে যে, ভারত বিশ্বব্যাপী যে ‘মাতবর’-এর কাজ করত সে জায়গা থেকেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শ্রীলঙ্কার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। চীনের প্রভাবও ধীরে ধীরে শ্রীলঙ্কার ওপর তৈরি হচ্ছে। আবার পাকিস্তান, মিয়ানমারেও সি পোর্ট তৈরি করেছে চীন। শ্রীলঙ্কায় সি পোর্ট তৈরি করছে চীন আর বাংলাদেশেও করার কথা ছিল। সুতরাং ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোডের যে বলয় তৈরির কথা তাকে হুমকির মুখে ফেলতেই এ হামলা চালানো হতে পারে।
এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এ হামলার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে বলে তার ধারণা। তার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন হচ্ছে, জাতিগতভাবে শ্রীলঙ্কার ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করতেই কোনো একটি গোষ্ঠী এ হামলা চালিয়েছে। তার পরও বোমা হামলা নানাভাবে করা হয়। সুইসাইড বোম্বার নিজেও জানে না যে, কোথায় কীভাবে তা বিস্ফোরণ করানো হচ্ছে। তিনি মনে করেন, শ্রীলঙ্কায় কোনো গোষ্ঠীর এমন ঘটনা ঘটেনি যে একসঙ্গে এতগুলো স্থানে একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে।
তাওহীদ জামায়াতের আঁতুরঘর ভারত
ওদিকে শ্রীলঙ্কায় হামলায় যে ইসলামি চরমপন্থী দলটি জড়িত বলে দাবি করেছেন দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা; সেই ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াত (এনটিজে) দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল ভারতের তামিলনাড়ুতে।
২০০৪ সালের ১৬ মে। ওইদিন ভারতের তামিলনাড়–তে জন্ম ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াতের। ভারত, শ্রীলঙ্কা-সহ এখন সতেরোটি দেশে দলটির শাখা রয়েছে। গত বছর চেন্নাইয়ে এক মার্কিন নাগরিককে মারধরের অভিযোগ উঠেছিল এই সংগঠনের বিরুদ্ধে। ভাষাগত, জাতিগত বিদ্বেষের ইতিহাস শ্রীলঙ্কায় পুরনো। কিন্তু ধর্মীয় সহিংসতার নজির সে দেশে খুব একটা ছিল না। সে কারণেই তামিলনাড়ু ন্যাশনাল তাওহীদ জামায়াতের উগ্রপন্থী নেতা পি জয়নুল আবেদিন যখন শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার কথা ছিল, তখন রাস্তায় নেমে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন মুসলিমদেরই একাংশ।
তদন্ত সহযোগিতায় আসছে এফবিআই
রয়টার্স বলছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিংহের সাথে এবং জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। ওয়াশিংটন পোস্টের খবর অনুযায়ী এফবিআই এজেন্ট পাঠানো হচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। তারা ল্যাবরেটরি টেস্টের জন্য বিশেষজ্ঞ সহায়তা দেয়ারও প্রস্তাব করেছে। এছাড়াও তদন্ত করবে অস্ট্রেলিয়া ফেডারেল পুলিশ গতকাল মঙ্গলবার অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন এ তথ্য জানিয়েছেন। 
বোরকা নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে
শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ বোমা হামলার ঘটনায় নারীদের জড়িত থাকার সন্দেহে বোরকার ও নেকাব পরিধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে দেশটির সরকার। সরকারের একটি উচ্চ মহলের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তারা এই বিষয়টি নিয়ে দেশটির মসজিদ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে যাচ্ছে। গত সোমবার বিষয়টি নিয়ে দেশটির মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা প্রেসিডেন্টের সাথেও কথা বলেছে। 
ভারত সীমান্তে হাই অ্যালার্ট!
ভারতে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ভারত-শ্রীলঙ্কা উপক‚ল এলাকায় বিশেষ টহল দিচ্ছে ভারতীয় বাহিনী। ভারত-শ্রীলঙ্কা পানিসীমায় কড়া নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া বিমানগুলোতেও নজরদারি চালানো হচ্ছে বলেও জানায় তারা। তাছাড়া ভারতে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ইন্ডিয়ান কোস্ট গার্ডকেও অতিরিক্ত সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 
শ্রীলঙ্কার মুসলিম শত্রুতা
যখন এটা পরিষ্কার নিরাপত্তা আর রাজনৈতিক ব্যর্থতা বলে বোঝা যায়, তখন সেখানে শ্রীলঙ্কার সমাজের মধ্যে সাম্প্রতিক বৈরিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গৃহযুদ্ধ চলার সময় তামিল টাইগারদের হামলার শিকার হয়েছে মুসলমানরা, নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছে। তবে সংখ্যাগুরু সিংহলিজ বুদ্ধ সম্প্রদায়ের হাতে সাম্প্রতিক একাধিক হামলার শিকার হওয়ার পর মুসলমান নেতারা বলছেন, শ্রীলঙ্কার সরকারও তাদের ভেতর আস্থা তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। গত বছর মার্চে ডিগানা শহরে মুসলমানদের দোকান ও মসজিদে সিংহলিরা হামলা করার পর একজন মারা যান।
সরকারে অভ্যন্তরীণ কোন্দল
হামলার ঘটনায় কিংবা আগেই হামলাকারীদের থামানো যেতো কি-না, তা নিয়ে সরকারের মধ্যকার কোন্দলের বিষয়টি উঠে আসায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অনেকেই। সরকার আগেই এনটিজের সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে খবর পেয়েছিলো ভারতীয়দের কাছ থেকে। যদিও সরকারেরই একজন মন্ত্রী বলছেন, প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিংহকে এটি জানানো হয়নি। আবার প্রেসিডেন্টে মৈত্রীপালা সিরিসেনার সাথে দ্ব›েদ্বর কারণে নিরাপত্তা বিষয়ক সভাগুলোতেও যোগ দেননি তিনি।
গত রোববার ইস্টার সানডে উদযাপনের সময় শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোসহ বিভিন্ন শহরের ৩টি গির্জা, ৩টি পাঁচ তারা হোটেল ও আরও দুটি স্থানে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অন্তত ৩২১ জন নিহত ও আরও কমপক্ষে ৫০০ জন আহত হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে ৩১ বিদেশি নাগরিকও রয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন, ৮ জন করে ব্রিটিশ ও ভারতীয়, যুক্তরাষ্ট্রের ৪, ডেনমার্কের ৩, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, চীন, তুরস্ক ও সুইজারল্যান্ডের দু’জন করে এবং নেদারল্যান্ডস, জাপান, পর্তুগাল, সউদী আরব ও বাংলাদেশের অন্তত একজন করে রয়েছেন। সূত্র : নিউজফার্স্ট, সিএনএন, ডেইলি মেইল, বিবিসি, এএফপি, মিরর ও গার্ডিয়ান।

কোন মন্তব্য নেই