সহকর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে! - TIMES EXPRESS | টাইমস এক্সপ্রেস is an interactive news portal

নিউজ ফাস্ট

সহকর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে!




সহকর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে! উষ্ণ হৃদ্যতাপূর্ণ, নাকি শীতল রসকষহীন। অফিস তো কেবল কাজেরই জায়গা নয়। একরকমের আবাস। সেখানেও সুস্থ-স্বাভাবিক মনোরম পরিবেশ থাকা চাই। অনেকে তাই অফিসকে বলেন, ‘সেকেন্ড হোম’। কেনই বা বলবেন না! কর্মস্থলে প্রত্যেক নারী ও পুরুষকর্মী সপ্তাহে পাঁচ-ছয় দিন, প্রতিদিন আট-নয় ঘণ্টা, কখনো আরও বেশি সময় কাটাচ্ছেন। কর্মজীবীর জন্য সেটা দ্বিতীয় আবাস তো বটেই।
প্রশ্ন হলো, কাজের জায়গায় সহকর্মীর সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন হবে! আরও সরাসরিই বলি, সহকর্মী যদি হয় একজন নারী বনাম একজন পুরুষ। বনাম বলাটা মনে হয় জুতসই হলো না। কেননা, নারীই হোক, কিংবা পুরুষ—অফিসে প্রতিটি সম্পর্কই হওয়া উচিত সৌহার্দ্যপূর্ণ, পারস্পরিক বোঝাপড়ায় উষ্ণ। কিন্তু এই কেতাবি কথা সব সময় আদবকেতা অনুযায়ী হয় না।


টানাপোড়েন নেই এমন সম্পর্ক আছে কি? চাওয়া-পাওয়া, দেনা-পাওনা প্রত্যেকটি সম্পর্কের সেতু। কর্মজীবনে বেশ একটা বড় সময় আমাদের কর্মস্থলে কাটাতে হয়। পরিবারের পাশাপাশি সহকর্মীদের সঙ্গেও একটি নতুন পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অফিস যেন আরও একটা পরিবার। সহকর্মীরাও পরিবারের সদস্যদের মতোই আপদ-বিপদে পাশে দাঁড়ায়। ২৪ ঘণ্টার তিন ভাগের এক ভাগই কেটে যায় কর্মস্থলে। সে তুলনায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দৈনন্দিন সময় কাটে কম। তাহলে এই দ্বিতীয় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অম্ল-মধুর সম্পর্ক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠাটা স্বাভাবিক।
কিন্তু সমস্যা বাধে তখনই, সম্পর্কের গভীরতা যখন বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে বেড়ে যায়। সহকর্মীদের চটুল আলোচনার খোরাক হয়ে দাঁড়ায়।
অফিসে একজন নারী ও একজন পুরুষের আন্তরিক বন্ধুসুলভ আচরণ অনেক সময় সহজভাবে দেখা হয় না। গোড়াতে কানে কানে ফিসফাস, তারপর গুঞ্জন—শেষমেশ গুজব রটতে আর সময় নেয় না। যত দিন যায় আশপাশের উৎসুক চোখগুলো খাঁড়া কান পেতে বসে থাকে কোথাকার পানি কোথায় গড়ায় দেখার ও জানার জন্য। দুপুরের খাবার টেবিলে আর বিকেলে চায়ের ক্যানটিনে ঝালমুড়ি চানাচুরের মতোই প্রসঙ্গটি বেশ কুড়মুড়ে।
একবার একজন নারী ও একজন পুরুষ এলেন। দুজনে একই অফিসে চাকরি করেন। নারীর স্বামী আছে। আর দুই বাচ্চা। পুরুষটি নববিবাহিত। স্ত্রী চাকরি করেন না। নারী সহকর্মী নিয়মিত বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে আসেন। অফিসের ক্যানটিনে খেলে খরচ বেশি পড়ে। দুপুরে যখন খেতে বসেন পাশের পুরুষ কর্মীকে নিজের রান্না করা খাবার পাতে তুলে দেন। ক্রমেই অফিশিয়াল সম্পর্ক বন্ধুত্বের সম্পর্কে মোড় নেয়। পুরুষ সহকর্মী নারীর বাসায় যেতেন। তাঁর স্বামী-বাচ্চাদের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো। কিন্তু তাঁর স্ত্রী এই সম্পর্ককে মেনে নিতে পারছেন না। পুরুষ কর্মীর স্ত্রীও রান্না করে খাবার সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু সহকর্মীর দেওয়া খাবার প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না পুরুষটি। নারী সহকর্মীও তখন মন খারাপ করেন। রান্নার পরিমাণ আগের মতোই তিনি বেশি আনেন। পুরুষটি না খেলে তিনি কথা বন্ধ করে দেন। আর কথা বন্ধ করে দিলে পুরুষ সহকর্মী কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না। সারাক্ষণ ব্যাপারটি নিয়ে চিন্তা করেন। মনের বড় বিচিত্র গতিমতি। নারী ও পুরুষ দুজনেই বন্ধুতার গণ্ডির মধ্যেই মান-অভিমানে জড়িয়ে পড়েন। এতে অফিশিয়াল সম্পর্কের চেয়ে অন্য সম্পর্কের উঁকিঝুঁকি দেখা যায়। মান-অভিমান এখন সবার চোখেই ধরা পড়ে।

তাতে দেখা দেয় নানা জটিলতা।
ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেন এক ব্যক্তি। ব্যবসার প্রয়োজনে প্রায়ই দেশি-বিদেশি নারী-পুরুষের সঙ্গে গাইড হিসেবে বাইরে থাকতে হয়। যখন বাড়ি ফেরেন, তখন বেশ ক্লান্ত থাকেন। স্ত্রীর তিক্ত কথা তখন মনকে বিষিয়ে তোলে। ছেলেমেয়েরা আগে মায়ের পক্ষ নিত। বাবাকে ভুল বুঝত। এখন বড় হয়েছে। বাস্তবতা বুঝতে পারে। কিন্তু স্বামী বেচারা কিছুতেই স্ত্রীকে বোঝাতে পারেন না। পেশাগত দায়িত্ব নিছকই গৎবাঁধা কাজ। নারীদের সঙ্গে ঘুরলেই তা সান্নিধ্যের মধ্যে পড়ে না। তেমন কোনো সুযোগও নেই। তাহলে সমস্যাটা কার বা কাদের?
২৯-৩০ বছর বয়সী এক নারী। কাজকর্মে কথাবার্তায় বেশ চটপটে। অল্প দিনেই কাজগুলো ধরে ফেলেছেন। পুরুষ বস তাঁর কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ। প্রায়ই বিভিন্ন দায়িত্ব চাপিয়ে দেন। ব্যাপারটিকে অন্য নারী-পুরুষ সহকর্মী বাঁকা চোখে দেখতে বেশি সময় নেন না। তাঁরা নিজেদের অপাঙ্ক্তেয় মনে করছেন। নারী কর্মী বলেন, ‘সবাই কানাকানি করেন। টের পাই। কিন্তু কিছু বলতে পারি না। কেউ কেউ সুযোগ পেলেই চটুল মন্তব্য করেন। টিটকিরি দিতেও কেউ ছাড়েন না।’
বেশির ভাগ কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সংখ্যা বেশি। তবে এখন সমাজ ও দেশের প্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারী কর্মজীবীর সংখ্যা বাড়ছে। সচল সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটবে। কাজের দুনিয়ায় নারী এখন অন্য গ্রহের প্রাণী নয়। পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে নারী-পুরুষ সহকর্মীদের একত্রে পথচলা স্বাভাবিক। আমাদের চিন্তাভাবনা আধুনিক, বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত।
দুই অবিবাহিত সহকর্মীর সম্পর্ক যদি বন্ধুত্ব, সহমর্মিতার ধারাবাহিকতায় একসময় বিয়েতে গড়ায়, তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু নানা রকম ছন্দপতন যেমন কর্মক্ষেত্রে থাকে। তেমনি কিছু বিচ্যুতিও ঘটে বৈকি।
কর্মস্থলে আচরণ কেমন হওয়া উচিত?
যেহেতু অফিসে দিনের বড় একটা সময় কাটাতে হয়, তাই কর্মক্ষেত্রে সম্পর্ক হওয়া চাই পারিবারিক সম্পর্কের মতোই সৌহার্দ্যের। পারস্পরিক নির্ভরতা স্বাভাবিকভাবে যেন গড়ে ওঠে। অফিসের সহকর্মী বা কর্তার সঙ্গে বন্ধুত্বই হোক আর নির্ভরতাই হোক—সেটা যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়। এই মাত্রা নির্ধারণ অফিস আদেশ বা কোনো সংবিধি দিয়ে সম্ভব নয়। নারী হোক কিংবা পুরুষ, প্রত্যেকেরই নিজেদের আচরণের সীমা নিয়ে দায়িত্ববান থাকা উচিত। প্রত্যেকের মনে রাখা উচিত, যার যার নিজস্ব পারিবারিক জীবন সবচেয়ে বেশি আপন। ছেলেমেয়ে, স্বামী বা স্ত্রী এঁদের জন্যই এই চাকরি করতে আসা। আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদার সঙ্গে তা করা উচিত।

পেশাগত কাজে দক্ষতা বাড়ানোর দিকে লক্ষ রেখে চললে এসব সমস্যা কমে যাবে।
সহকর্মী নারী বা পুরুষ হোক, বন্ধুতার সম্পর্কই কাম্য। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব যেন মান-অভিমানের জটিলতায় না গড়ায়। আলাদাভাবে না বসে সবার সঙ্গে একই টেবিলে বসে গল্প করা, খাবার ভাগাভাগি করা, প্রয়োজনে পারিবারিক জটিলতা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। তবে কিছু জটিলতা আছে যেমন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার একান্ত বিষয়-আশয়, তা নিয়ে বিপরীত লিঙ্গের সহকর্মীর সঙ্গে আলোচনা এড়িয়ে যাওয়া ভালো। এতে নারী অথবা পুরুষের সম্পর্কের জটিলতা অন্যদিকে মোড় নেওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
এটা ঠিক, অফিসের সহকর্মীরা অনেক ক্ষেত্রে সেফগার্ড। রোগে-শোকে, উৎসবে-আনন্দে, আইনি বা অর্থনৈতিক সমস্যায় তাঁরা জোট বেঁধেই পাশে দাঁড়ান। অফিসে সবার সঙ্গে সম্পর্ক হৃদ্যতাময় আন্তরিক হওয়া উচিত। বিশেষ কারও ওপর অতিনির্ভরতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জটিল সমস্যার জন্ম দেয়, সেটা মনে রাখতে হবে।
মিসরীয় এক মনোবিদ এ প্রসঙ্গে সকৌতুকে বলেছিলেন, ‘বসও (অফিস কর্তা) কিন্তু রক্তমাংসের একটা অফিস, বস কখনোই বয়ফ্রেন্ড নয়।’
আর কোরীয়দের দৃষ্টিভঙ্গিটা হলো, ‘অল ইজ ওয়েল’ ধরনের। সবাইকে বন্ধু ভাববে। সবাইকে বন্ধু জানবে। অফিস হলো সেই পরিবার, যেখানে তোমার ব্যক্তিগত কোনো বিষয় যদি বলতে চাও, তবে এমন জায়গায় বসে বলবে, যেন সবাই শুনতে পায়। যদি কেউ বাদ পড়ে, তবে অবশ্যই বিশেষভাবে তাকেও জানাতে ভুলবে না।
ভারতীয় এক বন্ধু মনোবিদের কথাও না বলে পারছি না। তিনি বলছিলেন, ‘এ নিয়ে ডেল কার্নেগি ঘেঁটে কিছু মিলবে না। তবে মনে রেখো, অফিস বা কর্মক্ষেত্রে এমন কোনো বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করবে না, যাতে সেখানকার পরিবেশ টিভি সিরিয়ালের মতো তিক্ত, দূষিত ও সন্দেহময় জটিল হয়ে ওঠে।’
সহকর্মীর সঙ্গে কেমন আচরণ
* কোনো একটি রটনা শুনলেই অমনি ‘প্রচারেই প্রসার’ বা ‘যা কিছু রটে কিছু তো বটে’ ভেবে বিষয়টিকে তিক্ত করে তোলা কাম্য নয়। বরং বিষয়টি যদি ঘনিষ্ঠ কোনো সহকর্মীকে নিয়ে হয়, তবে তার পাশে দাঁড়ান। তাঁকে সুপরামর্শ দিন।
* নারী-পুরুষ সম্পর্কের কোনো জটিলতা হলে সেটিকে রসাল আলোচনার খোরাক করা ঠিক নয়। এটা সবারই জানা যে চটুল ও খেলো গুজব-রটনার কারণে অনেক সময় সামান্য ঘটনা বড় কোনো অঘটনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
* একজন নারীর জন্য তাঁর পুরুষ সহকর্মী স্বজন নিশ্চয়। সম্পর্কের মধ্যে বন্ধুত্বের সৌরভ অবশ্যই থাকবে। পাশাপাশি এমন কোনো আচরণ কাম্য নয়, যা গুঞ্জনের বা রটনার রসাল খোরাক হতে পারে।
* একজন পুরুষের কাছে তাঁর নারী সহকর্মী অবশ্যই যেন মর্যাদায় আসীন হন। তাঁকে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। তাঁর অমর্যাদা কাজের পরিবেশের বিঘ্ন ও হানিকর।
পরিবারের সদস্যদের করণীয়
* একজন মানুষ চাকরি করে সংসারের আয়-উন্নতির জন্য।

স্বামী বা স্ত্রী কাজের জন্যই বাইরে যাচ্ছেন। বাসায় আসতে দেরি করছেন। কাজের বাধ্যবাধকতার জন্যই অনেক সময় সংসারে সময় দিতে পারেন না। এ নিয়ে টানাপোড়েন যেন না হয়, সেটা স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই খেয়াল রাখতে হবে। বলা হয়, সন্দেহ হলো তীব্র বিষ। এই বিষ নিঃশব্দে ছড়িয়ে যায়।
* বাইরে হেসে হেসে সবার সঙ্গে কথা বলা আর বাসায় এলেই মুখ ভার হাঁড়ির মতো—এটা কখনোই চলবে না। অফিস ও পরিবারে সহজ থাকুন। অফিসের কাজের তিক্ততা বাড়িতে টেনে আনা ঠিক নয়। তেমনি বাড়ির কোনো কিছুর জের অফিসে যেন না যায়। অফিসের কোনো রটনা কানে এলেই উত্তেজনা কাম্য নয়। আগে সত্য জানুন।
* নিজেদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি মিটিয়ে ফেলা উচিত। অফিসের সমস্যা অফিসে রেখে আসা উচিত। অফিসের ঝামেলা কখনো ঘরে আনা ঠিক নয়।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।


সূত্র
২৬ আগস্ট ২০১৫
 


কোন মন্তব্য নেই